আপনি কি শীতে হাড় ও জয়েন্টের ব্যথায় ভুগছেন? বুঝতে পারছেন না ব্যথা উপশমে কি করবেন? তাহলে আর চিন্তাই নেই! এই ব্লগটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন আর শীতে হাড় ও জয়েন্টের যত্ন কীভাবে নেবেন জেনে নিন।
দুর্বিষহ গরম থেকে সাময়িক প্রশান্তি দেয়া শীতকাল আমাদের অনেকেরই পছন্দ। ঘোরাঘুরি, পিঠা উৎসব, অতিথি পাখির আগমন, সব মিলিয়ে আমাদের দেশটা যেন উৎসবের ঋতু হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই যেন এই আনন্দে বাঁধ সাধে হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা।
শীতে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে জয়েন্ট এবং পেশীর ব্যথা বেশি দেখা দিলেও সব বয়সীরাই এর ভুক্তভোগী হতে পারে। কিছু নিয়ম অনুসরণ করেই এই ব্যথা থেকে অনেকটা আরাম পাওয়া যায়। এই ব্লগে আমরা হাড় ও জয়েন্ট পেইনের কারন ও মুক্তির উপায় নিয়ে আলোচনা করবো। তাহলে, শুরু করা যাক!
শীতে হাড় ও জয়েন্টে ব্যথার কারনে নড়াচড়া সীমিত করা সহ নানা রকম সমস্যা তৈরি হতে পারে। এই ব্যাথার কয়েকটি প্রধান কারন হচ্ছেঃ
বার্সা হল একটি ছোট, তরল-ভরা থলি যা সাধারণত শরীরের এমন অংশে অবস্থান করে যেখানে টেন্ডন, পেশী এবং হাড় একে অপরের বিরুদ্ধে ঘর্ষণ তৈরি করে। বার্সার ভিতরের তরল লুব্রিকেন্ট হিসাবে কাজ করে এই ঘর্ষণ কমায় এবং সংলগ্ন টিস্যুগুলির মসৃণ ও ব্যথামুক্ত ব্যথামুক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করে।
বারসায় সৃষ্ট প্রদাহকে বার্সাইটিস বলে। বার্সাইটিস শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে হতে পারে তবে এটি কাঁধ, কনুই, নিতম্ব, হাঁটু এবং গোড়ালিতে বেশি দেখা যায়। যদিও বার্সাইটিস ঋতুগত নয়, তবে ঠান্ডা তাপমাত্রা বারসাইটিস উপসর্গের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।
শীতকালে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের স্বল্পতা, জয়েন্টের শক্ততা ইত্যাদি বার্সাইটিসের কারন হতে পারে। এছাড়া যথাযথ ওয়ার্ম-আপ ছাড়া শীতকালীন ক্রীড়ায় অংশগ্রহণও অবদান রাখতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ্রাইটিস ফাউন্ডেশনের মতে , শীতকালে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (আর্থ্রাইটিস টাইপ) সংক্রান্ত জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এসময়ে আমাদের অস্থিসন্ধিতে থাকা পিচ্ছিলকারক পদার্থ (সাইনোভিয়াল ফ্লুইড) কিছুটা ঘন হয়ে যায় এবং জয়েন্টের নাড়াচাড়ায় বাধা সৃষ্টি করে।
আর্থ্রাইটিসের কারনে জয়েন্টগুলোর শক্ততা, ফোলাভাব এবং ব্যথা অনুভব হয়। শীতকালে ব্যারোমেট্রিক প্রেশার (আবহমানসংক্রান্ত চাপ), আর্দ্রতার পরিবর্তন, সীমিত শারীরিক কার্যকলাপ, ভিটামিন ডি-এর অভাব আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
শীতকালে আমরা সূর্যের আলো কম সময় পেয়ে থাকি। এছাড়া অনেকে এসময় ঘরের মধ্যে থাকাই স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর সংস্পর্শের অভাবে ভিটামিন ডি এর অভাব দেখা যায় যা পেশী ও জয়েন্টে ব্যথার একটি কারন।
শীতে আপনার শরীরের থেকে বাইরের তাপমাত্রা কম থাকে। এই তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রক্তনালী বা শিরা সংকুচিত হয়। রক্তনালী সংকোচনের কারনে জয়েন্টগুলোতে সীমিত রক্ত চলাচল হয় এবং জয়েন্টগুলোতে ব্যথা ও প্রদাহ হতে পারে।
ফ্র্যাকচার এবং পুরানো আঘাত শীতকালে জয়েন্টের ব্যথা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। পূর্বে প্রাপ্ত আঘাতে অনেক সময় স্নায়ু পুরোপুরি নিরাময় হয় না এবং কিছু মাইক্রোস্কোপিক ক্ষতি থেকে যেতে পারে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনে এই সকল আঘাত প্রাপ্ত স্নায়ুর উপর চাপ তৈরি করে এবং জয়েন্টগুলোতে অস্বস্তি হয়।
অতিরিক্ত ওজন জয়েন্টের ব্যথার কারন হতে পারে এবং এর প্রভাব শীতকালে আরও স্পষ্ট হতে পারে। শীতে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ কম হওয়ায় ওজন বেড়ে যেতে পারে। শরীরের এই অতিরিক্ত ওজন জয়েন্টগুলিতে চাপ বাড়ায়, বিশেষ করে হাঁটু এবং নিতম্বের মতো ওজন বহন করে। (পড়ুন হাঁটু ব্যথা কেন হয় এবং এর চিকিৎসা)
আমরা জানলাম শীতে হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা কি কারনে দেখা দিতে পারে। চলুন জেনে নিই এই ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে কি কি করনীয় রয়েছেঃ
শক্তিশালী হাড় বজায় রাখতে ভিটামিন ডি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সূর্যালোক থেকে বেশিরভাগ ভিটামিন ডি পাই। তাই শীতকালে সূর্যালোকের স্বল্পতায় এর ঘাটতি দেখা দেয়। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার এবং সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের মাধ্যমে এই চাহিদা মেটানো সম্ভব।
হাড়ের ঘনত্ব তৈরি এবং বজায় রাখার জন্য নিয়মিত শারীরিক ব্যায়ামের বিকল্প নেই। ওজন বজায় রাখার জন্য ব্যায়াম হিসাবে প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটুন, জগিং করুন বা টেনিস খেলুন। এর পাশাপাশি সপ্তাহে দুই বা তিনবার শক্তিবর্ধক ব্যায়াম (স্ট্রেংথ ট্রেনিং) করতে পারেন। সক্রিয় থাকার ফলে পেশী ও জয়েন্টগুলিকে নমনীয় থাকে।
ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার হাড় সূস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এ জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট খাবারের মধ্যে রয়েছে দুগ্ধজাত খাবার, পাতাযুক্ত শাক, ব্রোকলি, টোফু, ফোর্টিফাইড সিরিয়াল, কমলার রস ইত্যাদি। এই খাবারগুলি হাড়ের সর্বোত্তম স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ সরবরাহ করে।
এছাড়া জয়েন্ট এবং হাড়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন সি, কোলাজেন সমৃদ্ধ সুষম খাদ্যগুলোও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যেমন সয়াবিন, সবুজ শাকসবজি, বাদাম, বীজ, চর্বিযুক্ত মাছ, ইত্যাদি।
ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে পেশী টানটান হতে পারে এবং জয়েন্টগুলোতে ব্যথা হতে পারে। সর্বদা নিশ্চিত করুন যে আপনার হাঁটু, পা, হাত, ঘাড় এবং অন্যান্য আর্থ্রাইটিস প্রবণ অংশ শীতবস্ত্র দিয়ে ঢাকা রয়েছে। গ্লাভস, টুপি এবং মোটা মোজা সহ স্তরবিশিষ্ট কাপড় শীত মোকাবেলায় সাহায্য করে।
অতিরিক্ত ওজন হাঁটু এবং নিতম্বের মতো ওজন বহনকারী জয়েন্টগুলিতে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি চাপ দেয়। এতে জয়েন্টে ব্যথা হয় এবং স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়। আপনার ওজন একটি স্বাস্থ্যকর সীমার মধ্যে রাখতে সুষম খাদ্য গ্রহন এবং নিয়মিত ব্যায়ামের দিকে মনোনিবেশ করুন।
গ্লুকোসামিন ,কনড্রয়েটিন এবং ওমেগা-৩ এর মতো সাপ্লিমেন্ট জয়েন্টের প্রদাহ এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে। এক্ষেত্রে কোন সাপ্লিমেন্ট আগে আপনার ডাক্তারের সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করুন।
পানিস্বল্পতায় হাড় এবং জয়েন্টগুলি তরল হারায় যা এর ক্ষতির জন্য আরও সংবেদনশীল করে তোলে। হাইড্রেটেড থাকার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি এবং উষ্ণ তরল যেমন হারবাল চা গ্রহন করতে পারেন।
তাপ পেশি শিথিল করে। তাই হাড়ের জোড়ে কিংবা পেশিতে ব্যথা হলে গরম ভাপ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া কোল্ড থেরাপিও অসাড়তার মাধ্যমে ব্যথা উপশমে সাহায্য করতে পারে। শীতল ও গরমের কনট্রাস্ট বাথ থেরাপি শক্ত জয়েন্ট, নরম টিস্যুগুলির প্রদাহ, পেশীর খিঁচুনি এবং ব্যথা চিকিৎসায় সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত ঘুম হাড় এবং জয়েন্টের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যক। প্রতি রাতে ৭-৮ ঘন্টা ঘুম নিশ্চিত করুন। অপর্যাপ্ত ঘুম প্রদাহ বাড়াতে পারে, হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস সহ জয়েন্টে ব্যথা আরও খারাপ করতে পারে। নির্ভেজাল ঘুমের জন্য আপনার ঘরকে অন্ধকার, শব্দমুক্ত রাখুন এবং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস দূরে রাখুন।
শীতে পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকায় মনে বিমর্ষতা আসতে পারে। মন খারাপের জন্য শারীরিক অন্যান্য ব্যথার পাশাপাশি হাড় ও জোড়ের ব্যথাও বেশি মনে হতে পারে। তাই এসময়ে হাসি খুশি এবং মুড ভালো রাখাও জরুরি।
তাহলে, “শীতে হাড় ও জয়েন্টের যত্ন কীভাবে নেবেন জেনে নিন” সংক্রান্ত এই ব্লগের শেষ পর্যায় আমরা চলে এসেছি! আমরা জেনেছি কি কি কারনে শীতে হাড় ও জয়েন্টের ব্যথা হতে পারে এবং এর সমাধানে আমাদের কি কি করনীয়।
যদিও শীতের মাসগুলিতে জয়েন্টের ব্যথা বেশি অনুভব হতে পারে, আপনি এর বিরুদ্ধে নিরুপায় নন। হাড় এবং জয়েন্টের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য আপনার সুষম খাদ্য, শরীরচর্চা এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
পরিশেষে আশা করছি এই সকল উপায় অবলম্বন করে আপনি জয়েন্টের ব্যথা কমাতে ও শীত উপভোগ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে যদি আপনার জয়েন্টগুলিতে অত্যন্ত ব্যথা অনুভব করেন বা ব্যথা দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে শরণাপন্ন হতে হবে।
Comments will be approved before showing up.