রমজানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস: কেমন হবে সেহরি, ইফতার, রাতের খাবার?

February 20, 2025

রমজানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস: কেমন হবে সেহরি, ইফতার, রাতের খাবার?

আবারও চলে এসেছে পবিত্র রমজান মাস, আত্মিক শুদ্ধি ও সংযমের শিক্ষা নিয়ে। রমজানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষই এই সম্পর্কে জানেন না।


ইফতারে তৈলাক্ত ও মসলাদার খাবার খেয়ে অনেকেই পেটের স্বাস্থ্য নষ্ট করেন। এর ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও শক্তি শরীরে পৌঁছায় না। সেহরির খাবারও অনেকে সঠিকভাবে খান না, যার ফলে দিনভর ক্লান্ত বোধ করেন। এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই সময়ে কোন খাবারগুলো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং কোনগুলো এড়িয়ে চলা উচিত?


চিন্তা নেই! আমাদের এই ব্লগে আমরা সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যাতে আপনি রমজানে সুস্থ থাকতে পারেন। তাহলে আর দেরি কেন? শুরু করা যাক।

রমজানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস চর্চা

রমজান মাস শুধুমাত্র আমাদের আধ্যাত্মিক শুদ্ধি সাধনের মাস নয়, এটি আমাদের খাদ্যাভ্যাসে সংযম বজায় রাখার শিক্ষাও দেয়। যেহেতু আমরা সারাদিন উপবাস করি, তাই রমজানে আমাদের খাদ্য গ্রহণে অতিরিক্ত সচেতন ও সংযত হওয়া উচিত। চলুন জেনে নেই এ সময়ের খাদ্যাভ্যাসের বিস্তারিতঃ 

সেহরির খাবার

রমজানে সুস্থ থাকা এবং সারাদিন চলার শক্তি সঞ্চারের জন্য সেহরিতে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সেহরিতে ভাতের সাথে কম মশলাযুক্ত সবজি, মাছ বা মাংস এবং ডাল খাওয়া যেতে পারে। প্রতিদিন ভাত না খেয়ে বিকল্প হিসেবে দই-চিড়া বা ওটস খাওয়া উপকারী।


যারা হালকা খাবার পছন্দ করেন, তারা এক গ্লাস দুধ, একটি ডিম সেদ্ধ, একটি কলা বা কয়েকটি খেজুর খেতে পারেন। এই খাবারগুলো সারাদিনের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি প্রদান করবে।


সেহরির খাবার অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত ও সহজপাচ্য হতে হবে। অধিক তেল, অধিক ঝাল এবং অধিক চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। প্রোটিনের জন্য মাছ এবং সবুজ শাকসবজি গ্রহণ করা ভালো। 


আঁশযুক্ত খাবার যেমন ডাল, খোসাসহ আলু, বাদামি চাল, বাদাম এবং ফলমূল খেলে ক্ষুধা কম অনুভূত হয় এবং শরীর আর্দ্র থাকে। সেহরির সময় কয়েকটি খেজুর বা কলা খেলে ফাইবারের চাহিদা পূরণ হয়।


সেহরিতে পুষ্টিকর কিন্তু ভারী নয়, এমন খাবার উপকারী। দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, সালাদ, ফলমূল, স্যুপ, অলিভ অয়েলে রান্না করা সবজি, হোলগ্রেইন বা পূর্ণাঙ্গ শস্যের রুটি এবং সিরিয়ালের মতো জটিল শর্করা খাবার এর অন্তর্ভুক্ত। এই ধরনের খাবার ধীরে ধীরে শরীরে শক্তি সঞ্চার করে এবং সারাদিনের জন্য শক্তি প্রদান করে।


সেহরিতে পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত এবং লবণাক্ত খাবার ও ক্যাফেইন যুক্ত পানীয় পরিহার করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে পানি-শূন্যতা এবং তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেহরির সময় শেষ হওয়ার অন্তত আধা ঘণ্টা আগে খাবার খাওয়া উচিত।

ইফতারের খাবার

ইফতারে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। রোজা ভাঙ্গার সময় প্রথমে পানি ও খেজুর দিয়ে শুরু করা উচিত, যা শরীরে শক্তি ও পানির ঘাটতি পূরণ করে। এরপর স্যুপ বা লাইট খাবার যেমন ডাল, শিম বা মটরশুঁটি দিয়ে তৈরি খাবার গ্রহণ করা ভালো। এ ধরনের খাবার দেহে পুষ্টি  যোগায়।


আমাদের দেশে ইফতারে প্রচুর ভাজাপোড়া খাওয়া হয়, যা শরীরের জন্য মোটেও ভালো নয়। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবারও পরিহার করা উচিত। ইফতারে পেট ঠাণ্ডা রাখে এমন খাবার যেমন দুধচিড়া, দই-চিড়া বা মুড়ি খাওয়া উপকারী। এগুলো পেট ঠাণ্ডা রাখে, একই সাথে হজমে সাহায্য করে।


পেটের সমস্যা এড়াতে ডাবের পানি, তোকমা, ইসবগুল ও তাজা ফলের রস এ সময়ে সাহায্য করে। ইফতারের পর অতিরিক্ত চা, কফি বা কোমল পানীয় পান এড়িয়ে চলা উচিত। 


অমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই ইফতারে সরবত খাওয়ার অভ্যাস আছে। অনেকেই এই সরবত অতিরিক্ত চিনি দিয়ে বানিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে চিনির পরিবর্তে মধু ব্যবহার করে সরবত বানালে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে অধিক পুষ্টিকর হবে। ( মধুর উপকারিতা সম্পর্কে জানুন) 


এছাড়া, ইফতারে বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন স্টার্চসমৃদ্ধ খাবার, আঁশসমৃদ্ধ সবজি-ফলমূল, দুগ্ধজাত খাবার, প্রোটিনসমৃদ্ধ মাছ-মাংস বা ডিম ভারসাম্য রেখে খাওয়া উচিত। খাবার খেতে হবে ধীরে ধীরে এবং ভালো মতো চিবিয়ে।এতে করে শরীর সুস্থ থাকবে এবং পরের দিনের রোজা রাখার জন্য উৎসাহ বজায় থাকবে।

রাতের খাবার

সেহরি ও ইফতারের পর আসে রাতের খাবারের পর্ব। রাতের পরিমিত খাবার গ্রহনের জন্য এ টিপসগুলো অনুসরণ করতে পারেন:


  • ইফতারে যদি হালকা খাবার গ্রহণ করা হয়, তবে রাত ১০ টার মধ্যে ভাত, সবজি, ডাল, মাছ, মাংস সমৃদ্ধ রাতের খাবার সেরে নেয়া উচিত।

  • ইফতারে যদি ভারি খাবার খাওয়া হয়, তবে রাতের খাবারে হালকা খাবার যেমন ভাত, সবজি, ডাল প্রাধান্য দিন।

  • রাতের খাবারে দ্রুত হজমযোগ্য খাবার গ্রহণ করা উচিত, যাতে রাতে কোনো অস্বস্তি না হয়।

  • রাতের খাবারে সালাদের সঙ্গে পুদিনা পাতা কুচি এবং জিরা পানি অ্যাসিডিটি দূর করতে সাহায্য করে।

  • রাতের খাবারে স্যুপ, দুধের সঙ্গে কলা, খেজুর, বাদামসহ শেক, সালাদ ইত্যাদি হালকা খাবার গ্রহণ করা ভালো।

  • রাতের খাবারে পানির পরিমাণ বেশি যেমন লাউ, পেঁপে, চিচিঙ্গা, চালকুমড়া ইত্যাদি সবজি গ্রহণ করা উচিত, যা শরীরকে দীর্ঘসময় হাইড্রেটেড রাখে।

  • রাতের আহারে রুটি অথবা এক কাপ চালের ভাত সাথে সবজি, মাছ বা কিছুটা মাংস নেওয়া যায়। ভাতের পরিমাণ সীমিত রাখা উত্তম।

সব মিলিয়ে, রাতের খাবারে পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি হজমের সুবিধার্থে হালকা এবং পানি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত। এতে করে রাতে কোনো অস্বস্তি হয় না এবং পরের দিনের রোজা রাখার জন্য শরীর তৈরি থাকে।


রমজানে যে সকল খাবার পরিহার করা উচিত

রমজানে সুস্থ থাকতে এবং সঠিকভাবে রোজা পালন করতে কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এখানে এমন কিছু খাবারের তালিকা দেওয়া হলো যা রমজানে এড়ানো উচিত:


  • তৈলাক্ত এবং ভাজাপোড়া খাবার: সারাদিন উপবাস থাকার পর  ভাজাপোড়া খাবার হজমে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে এবং গ্যাস, পেট ফাঁপাসহ নানা সমস্যার কারন হতে পারে।

  • অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার : এগুলো শরীরে চিনির মাত্রা হঠাৎ বাড়িয়ে দিতে পারে, যা পরবর্তীতে ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করার কারণ হতে পারে।

  • সোডিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার : লবন বা সোডিয়াম যুক্ত খাবার শরীরে পানির ঘাটতি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

  • ঝাল এবং মশলাদার খাবার : ঝাল ও মশলাযুক্ত খাবার ইফতার ও সেহেরীতে এড়িয়ে যাওয়া উত্তম। এই প্রকার খাবার পেটে জ্বালা এবং অন্যান্য অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।

  • উচ্চ-ফাইবার খাবার: এগুলি পেট ফাঁপা এবং পেট শক্ত হওয়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

  • স্টার্চযুক্ত খাবার : মিষ্টি আলু, আলু এসকল স্টার্চ সমৃদ্ধ খাবার পেটে অস্বস্তি এবং ভারী অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।

  • প্রক্রিয়াজাত খাবার:   প্রসেস করার প্রক্রিয়ায় খাবারে অধিক পরিমান সোডিয়াম, পটাশিয়াম যুক্ত হয়। এগুলি ওজন বৃদ্ধি এবং পেটের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

রমজানে সুস্থ থাকার টিপস

পবিত্র রমজান মাসে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারণ বজায় রাখা ও সুস্থ থাকার জন্য এখানে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল:


  • অনেকেই সেহরি না করে রোজা রাখেন। সেহরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারন এ সময়ে খাওয়া খাবার আপনার সারাদিন চলার শক্তি প্রদান করে।

  • পানির ঘাটতি পূরণে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় অন্তত এক গ্লাস পানি পান করুন। এছাড়া আপনি চিনিমুক্ত ফলের রস ও পান করতে পারেন। এতে শরীর হাইড্রেটেড থাকবে।

  • খাবার ধীরে ধীরে চিবিয়ে খান। বড় পরিমাণে খাবার দ্রুত নেওয়া হলে হার্টবার্ন এবং অস্বস্তি হতে পারে।

  • রাতে যথেষ্ট ঘুমানোর চেষ্টা করুন যাতে দিনের বেলা সতেজ থাকতে পারেন।

  • চা, কফি বা অন্যান্য ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় কম পান করুন। এগুলো পানির পিপাসা বাড়ায় এবং ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্স কমাতে পারে। হারবাল চা একটি ভালো বিকল্প। 


মনে রাখবেন, প্রত্যেকের শরীর আলাদা এবং যা একজন ব্যক্তির জন্য ভাল কাজ করে, তা অন্য ব্যক্তির জন্য ভাল কাজ নাও করতে পারে। রমজানের সময় আপনার জন্য সঠিক খাদ্য তালিকা নির্ধারণ করতে সর্বদা একজন স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী বা পুষ্টিবিদের সাথে পরামর্শ করে নিতে পারেন।


উপসংহার

রমজান মাস শুধু আত্মিক শুদ্ধি ও ইবাদতের মাস নয়, বরং সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার একটি অনন্য সুযোগ। কিন্তু রমজানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ না করার ফলে অনেকে পেটের সমস্যা, আলসার, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, অ্যাসিডিটিসহ নানা সমস্যায় ভুগে থাকেন। এছাড়া অনেকের ওজনও বেড়ে যায়।


কি করনীয়? সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান, এবং সঠিক ঘুমের অভ্যাস আমাদের রোজা পালনকে সহজ এবং স্বাস্থ্যকর করে তোলে। আশা করছি এই ব্লগটিতে আমরা যে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আলোচনা করেছি এগুলো অনুসরণ করে আপনি রমজান মাসে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে পারবেন।


 রমজান মুবারক!



References:


  1. https://www.bda.uk.com/resource/ramadan-and-diet.html
  2. https://www.bbc.com/bengali/articles/cd1w913g2ldo
  3. https://www.halaltimes.com/ramadan-meal-guide-optimal-times-and-nutritious-foods-to-eat/

Leave a comment

Comments will be approved before showing up.

Subscribe