আপনি কি আপনার অতিরিক্ত ওজনের জন্য প্রায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন? আপনি কি জানতে চান কিভাবে সহজে ওজন কমানোর খাবার তালিকা তৈরী করবেন? শুধু আপনি একা নন, আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি।
সঠিক শারীরিক গঠন এবং সুস্থ থাকতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ মানুষই খাবারের ব্যাপারে সচেতন থাকে না। শুধু তাই নয়, আমরা অনেকেই জানিনা কোন খাবারগুলো শরীরের ওজন বাড়ায় আর কোনগুলো ওজন কমাতে সহায়ক। একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শুধুমাত্র ওজন কমাতে সহায়কই নয়, বরং এটি আপনার সার্বিক সুস্বাস্থ্যের জন্যও প্রয়োজন।
তাই আমরা এই ব্লগে এমন কিছু খাবারের তালিকা তৈরি করেছি যা আপনার ওজন কমানোর যাত্রায় সহায়ক হতে পারে। এবং এই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবারগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজারে সহজলভ্য এবং স্বল্প মূল্যেই পাওয়া যায়।
তাহলে আর দেরি কেন? চলুন আজই আপনার ওজন কমানোর যাত্রা শুরু করা যাক!
অতিরিক্ত ওজন কমানোর খাদ্য তালিকা দেখার আগে আপনাকে বুঝতে হবে কিভাবে ওজন বেড়ে/কমে যায়। শক্তির একককে বলা হয় kilojoules (kJ), খাবার গ্রহণের মাধ্যমে kJ সঞ্চিত হয় এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে তা খরচ হয় (1) ।
আপনি যদি বেশি kJ/ calorie গ্রহণ করেন এবং সেই তুলনায় কম কাজ করেন তাহলে আপনার ওজন বেড়ে যাবে। তাই চলুন এমন কিছু ওজন কমানোর খাবার তালিকা জেনে নিন যা আপনার সুসাস্থ বজায় রাখতে সাহায্য সহায়ক হবে।
ফল ও শাকসবজি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ তাই এগুলো আমাদের শরীরের জন্য খুবই ভালো। এছাড়াও ফল ও শাকসবজিতে ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায় যা ওজন কমানোতে সাহায্য করে (2) । এখানে ওজন কমাতে সাহায্যকারী কয়েকটি ফল এবং সবজির নাম দেওয়া হলো:
পেঁপেতে পাপেইন নামক একটি এনজাইম থাকে যা হজম শক্তি বৃদ্ধির করে এবং পুষ্টি শোষণে সাহায্য করে। সেই সাথে এতে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং ফাইবার থাকে যা আপনাকে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই যদিও এটি সরাসরি ওজন কমাতে পারে না, কিন্তু ওজন কমাতে গুরুত্তপূর্ণ ভূমিকা পালন করে (3) ।
ফুলকপি (Cauliflower) ওজন কমানোর সহায়ক একটি উপযুক্ত খাবার। কারণ এতে ক্যালোরি কম থাকে আর ফাইবার থাকে অনেক বেশি, যা অনেক সময় ধরে আপনার পেট ভরা অনুভব করে (4) । আরেকটি বড় সুবিধা হলো ফুলকপি বিভিন্নভাবে রান্না করা যায়। যেমন অল্প তেলে ভেজে, স্যুপ তৈরী করে, মাছের সাথে রান্না করে ইত্যাদি।
ওজন কমানোর খাবার তালিকায় আপনি কলমি ও পালং শাক রাখতে পারেন। এই শাকগুলিতে প্রচুর পরিমানে ফাইবার থাকায়, দীর্ঘ সময় আপনার ক্ষুধা পেট ভরা অনুভব করায়। এছাড়াও পালং শাকে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, সি, ই, যা হাটু বেথা ও হাটু ক্ষয় রোধে অত্যন্ত কার্যকরী (5) ।
ঢেড়স আমাদের সাস্থের জন্য খুবই উপকারী একটি সবজি যাতে ক্যালোরির পরিমান খুবই কম থাকে। তাই গবেষকদের মতে, এই সবজিটি খেলে আপনার ওজন কমাতে সহায়তা করতে পারে। এছাড়াও এটি ক্যান্সার, ডায়াবেটিক্স, ও হার্টের মতো ভয়াবহ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে (6) ।
তবে আপনার যদি জয়েন্টে ব্যাথা ( Joint Pain ) থাকে তাহলে এই সবজিটি এড়িয়ে যাওয়ায় ভালো। কেননা এতে solanine নামক একটি পদার্থ থাকে যা বাথ, ব্যাথা বৃদ্ধি করতে পারে (7) ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিসার্চে পাওয়া গেছে ওজন কমানোর খাবার তালিকায় শাক-সবজির থেকে ফল বেশি কার্যকরী (8) । বিশেষ করে আপেল, বেরি এবং নাশপাতিতে ক্যালোরির পরিমান কম থাকে এবং ফাইবার বেশি থাকে। তাই আশা করা যায় এই ফলগুলো খেলে আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করবে।
আপনার খাদ্য তালিকায় এই ফল এবং সবজিগুলো যুক্ত করতে পারেন যা হতে পারে আপনার অতিরিক্ত ওজন কমানোর উপায়।
আমরা খাবার গ্রহণের পর তা হজমের জন্য কিছু ক্যালোরি খরচ হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'তাপীয় প্রভাব' (thermic effect of food) (9) । প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাবার হজম হয়। তাই ক্যালোরি সঞ্চিত হয় কম এবং আপনার ওজন কমানোর সম্ভাবনা তৈরী হয়।
আমাদের প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য তালিকায় প্রথমেই রাখা যাক ব্রাউন এবং লাল চাল। এই ধরণের চালে প্রচুর পরিমানে ফাইবার, ভিটামিন এবং খনিজ থাকে। ফলে অল্প খাবারেই আপনি সারাদিন energetic থাকবেন এবং কম খেতে চাইবেন। এছাড়াও, ব্রাউন এবং লাল চাল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে দারুণ উপকারী।
ওটস হল সহজলভ্য, স্বাস্থ্যকর, এবং এটি প্রোটিন ও ফাইবারের আরেকটি চমৎকার উৎস ( 10 )। এর ফাইবার আপনার ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। ফলে, আপনি কম খেয়েও ওজন কমাতে পারবেন। এছাড়াও, ওটস হজমে সহায়তা করে ও কোলেস্টেরল কমাতে সহায়ক যা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
প্রোটিনের তালিকায় সহজলভ্য টুনা মাছ না থাকলে তালিকাটি পূর্ণতা পায় না। টুনা মাছে কম চর্বি থাকে, কিন্তু প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। এটি পেশী গঠনে এবং ওজন কমানোতে দারুণ সাহায্য করে। এছাড়াও, টুনা মাছে থাকা ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় ( 11 )।
ওজন কমানোর খাবার তালিকায় দুধ রাখতে পারেন যা উচ্চ-প্রোটিন খাবার হিসেবে পরিচিত। দুধ আপনার পেশী গঠনে এবং ওজন কমানোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন D সমৃদ্ধ, যা হাড়ের স্বাস্থ্য ( Joint Health ) এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ( 12 )।
কালো শিম অত্যন্ত সহজলভ্য, কিন্তু কার্যকর একটি প্রোটিন উৎস। ব্রকলিও কম ক্যালোরিযুক্ত এবং অধিক প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি সবজি। এই খাবার গুলোতে পেট ভরা রাখতে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যা পেশী গঠনে এবং ওজন কমানোর জন্য দারুণ উপকারী।
আমরা তেল বা চর্বি জাতীয় খাবারের নাম শুনলেই মনে করি এসব খাবার ওজন বৃদ্ধি করে। হ্যা, এটা অনেকাংশেই সত্যি কিন্তু আমরা অনেকেই এটা জানিনা যে কিছু কিছু তৈলাক্ত খাবার ওজন কমাতেও সাহায্য করতে পারে। শুধু তাই নয়, কিছু স্বাস্থকর তেল যেমন এক্সট্রা ভার্জিন অয়েল আপনার লিভারের সূস্থ্যতা ( Liver Health ) নিশ্চিত করে।
সাধারণত আমরা খাবারে সয়াবিন তেল ব্যাবহার করি যা আপনার ওজন বৃদ্ধি করার জন্য দায়ী হতে পারে। তবে আপনি যদি সয়াবিনের পরিবর্তে অলিভ অয়েল ব্যাহার করেন, তাহলে এটা আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে ( 12 )। এছাড়াও অলিভ অয়েল আপনার অন্ত্রের সুসাস্থের ( Gut Health) জন্য খুবই ভালো একটি উপাদান।
অবাক হচ্ছেন বাদাম কিভাবে আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করবে? বাদামে থাকে অনেক প্রোটিন এবং ফাইবার তাই দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে। ফলে, আপনি কম খাবার খাবেন এবং অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে বাদাম খাওয়া বিপাক বাড়াতে সাহায্য করে, যা শরীরকে আরও বেশি ক্যালোরি পোড়াতে সহায়ক ( 13 )।
ওজন কমানোর কথা চিন্তা করলে মাশরুম হয়তো কখনোই আপনার মাথায় আসে না। কিন্তু, গবেষণা বলছে ওজন কমানোর পথে মাশরুম আপনার হতে পারে আপনার অনেক ভালো বন্ধু। কারণ মাশরুমে ক্যালোরি অনেক কম থাকে, অধিক ফাইবার থাকে যা আপনার ক্ষুধা নিবারণ করে। তাই আপনার ওজন কমানোর খাবার তালিকায় মাশরুম রাখতে পারেন ( 14 )।
উপরোক্ত খাবারগুলো ছাড়াও কিছু ফারমেন্টেড খাবার যেমন ঘোল, মিস্টি দই, আচার, কিমচি ইত্যাদি ওজন কমানোর জন্য সহায়ক। এবং পানীয়র মধ্যে সবুজ চা, লেবু পানি, এবং নিয়মিত সাধারণ পানি পান করা আপনার ওজন হ্রাসে সাহায্য করতে পারে।
আপেল সিডার ভিনেগার হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং মেটাবলিজম বা বিপাক বৃদ্ধি করে। এতে থাকা অ্যাসিটিক অ্যাসিড ক্ষুধা কমায় এবং রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এছাড়া, এটি আপনার শরীরের চর্বি জমা কমাতে সহায়ক, ফলে ওজন কমাতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
শারীরিকভাবে সুস্থ এবং ফিটনেস ঠিক রাখতে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা অতিরিক্ত ওজন কমাতে সঠিক খাবার নির্বাচন আবশ্যক। তাই এই ব্লগে আমরা দিয়েছি ওজন কমানোর খাবার তালিকা, যা আপনার শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের পরিবেশ এবং খাদ্যাভ্যাসের সাথে মানানসই এমন অনেক খাবার রয়েছে যা ওজন কমাতে সহায়ক হতে পারে। পেঁপে, আমড়া, কলমি শাক, ঢেঁড়স, ফুলকপি, কলমি ও পালং শাক, এবং ঢেঁড়সের মত ফল ও শাকসবজি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং ওজন কমাতে কার্যকর।
একইভাবে, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন ব্রাউন/লাল চাল, ওটস, টুনা মাছ, দুধ, শিম, ব্রকলি এবং পেয়ারা ওজন কমানোর জন্য উপকারী। এই খাবারগুলিতে ক্যালোরি কম এবং ফাইবার ও পুষ্টিতে ভরপুর, যা দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে এবং হজম প্রক্রিয়া সুস্থ রাখে।
এই খাবারগুলো ছাড়াও, ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং পর্যাপ্ত ঘুমানো জরুরি। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমে ওজন কমানো সম্ভব এবং এটি আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
সর্বোপরি, আশা করি ওজন কমানোর যাত্রায় এই খাদ্যতালিকাটি আপনাকে সহায়তা করবে। তবে, প্রয়োজনে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। কারণ স্বাস্থ্যই সকল সম্পদের মূল ।
একজন সাধারণ মানুষের দৈনিক ক্যালরি প্রয়োজন নির্ভর করে তার বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা, শারীরিক গঠন, ইত্যাদির উপর। তবে, যদি একজন পুরুষ প্রতিদিন যে পরিমান ক্যালোরি বার্ন করতে তার অতিরিক্ত ২০০-৪০০ ক্যালোরি বেশি গ্রহণ করে তাহলে ওজন বাড়তে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১৫০-২৫০ ক্যালোরি ওজন বৃদ্ধির জন্য দায়ী হতে পারে।
আপনার ওজন কমাতে চাইলে রাতে হালকা এবং সহজপাচ্য খাবার খাওয়া উচিত। তাই আপনি শাকসবজি, স্যুপ, ডাল, ফল, ছানা, আমন্ড, দই, ইত্যাদি খেতে পারেন । ভারী খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন কারণ এতে হজমে সমস্যা হতে পারে এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
ওজন কমানোর জন্য প্রতিদিন আপনার গ্রহণ করা ক্যালোরির চেয়ে ২০০-৪০০ ক্যালোরি বেশি বার্ন করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি ১৫০০ ক্যালোরি বার্ন করতে পারেন, তাহলে আপনার জন্য ১২০০ এর বেশি ক্যালোরি গ্রহণ করা উচিত নয়।
Comments will be approved before showing up.